সৈয়দপুর – জীবন রূপান্তরের গল্প
ভাবুন তো সেইসব হাতগুলোর কথা, যেই হাত ভালোবাসার পরশে ঐতিহ্যকে বুনে চলে আর তৈরি করছে সেই সৌন্দর্য যা আপনার ঘরের শোভা বৃদ্ধি করে।
আমাদের প্রতিটি পণ্যের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নারীদের জীবনের গল্প, যারা প্রকৃতির দানকে আপনার ও আপনার প্রিয়জনদের জন্য অমূল্য সম্পদে রুপান্তরিত করছেন।
সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসের একটি উদ্যোগ স্বকীয়র পণ্য নির্বাচন করুন-যা একটি পণ্যের নির্বাচন শুধু নয়, বরং এর ফলে পরিবারগুলোতে সঞ্চারিত হয় আশা, নিশ্চিত করে শিশুদের আনন্দের সাথে মিশে থাকা সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষার আলো। প্রাচ্যের সাথে প্রতীচ্যের নান্দনিক এই সংযোগকে উপভোগ করুন যেখানে আধুনিক নান্দনিকতার সাথে সংমিশ্রিত আছে প্রাচীন প্রজ্ঞা।
রোজিনাঃ সুই এর প্রতি ফোড়ে বুনে চলা স্বপ্নের নাম
সেলাই মেশিনের ছন্দবদ্ধ ঘূর্ণনের মূর্ছনায় ঘর ভরে ওঠে আর রোজিনার চঞ্চল আঙ্গুলগুলো পাটের কাপড়ের উপর যেন নেচে চলে।
শুধু ব্যাগ নয়, যেন তিনি সেলাই করেন আশা, বুনে চলেন সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসে তার ১৬ বছরের অভিযাত্রার গল্প।
২০০৭ সালে রোজিনা যখন প্রথম কাজে যোগ দেন সেই রোজিনা আর আজকের রোজিনা এক নন। তিনি যখন কাজে যোগ দেন তখন জীবন যেন ঘিরে ছিলো অনিশ্চয়তায় জালে। টানাটানির মধ্যে দিন কাটতো চার সদস্যের এই পরিবারটির। স্বামীর কাঁচের দোকানের সীমিত রোজগার প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট ছিলো না। সেসময় দুর্বিসহ অসহায়তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে রোজিনাকে।
ঠিক তখুনই সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেস হঠাত এক ঝলক রোদের মত উদ্ভাসিত করে তার জীবন। ন্যায্য মজুরীর সাথে যে সম্মান আর মর্যাদা দেয়া হয় এখানে প্রতিটি নারীকে, তা ছিলো এক অনুপ্রেরণামূলক উপলব্ধি তার জন্য। রোজিনা তখন আর শুধু একজন স্ত্রী বা একজন মা নন-তিনি এক দক্ষ সেলাই অপারেটর, যার প্রতিটি সেলাই এ ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাস। তার উপার্জন হয়ে ওঠে পরিবারের ভরসা ও আশ্রয়। সেই আয় দিয়ে তিনি তার স্বামীকে তার ব্যবসায় সহযোগীতা করেছেন, তৈরী করেছেন ছোট কিন্তু মজবুত একটি ঘর। তার পুত্র শুভ, যে একসময় স্কুল ছাড়ার কথা ভেবেছিলো
সংসারে আর্থিক সহযোগীতা করবে বলে , এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করে সে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোজিনা যখন ছেলের কথা বলেন, তখন তার চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে ওঠে আনন্দমিশ্রিত গর্ব, যা তার এক অনন্য অর্জন।
মেয়ে মিমকেও এখন আর স্কুল মিস করতে হয়না পোশাক বা বই-খাতার অভাবে।আজ সে এক প্রাণবন্ত উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী, তার হাসিতে ভরে ওঠে তাদের ছোট্ট গৃহকোণ।“সবকিছুই সম্ভব” মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলেন রোজিনা। সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেস শুধু আমার জীবন নয়, আমার পুরো পরিবারকেও বদলে দিয়েছে রোজিনার এই গল্প শুধু তার একার নয়, এটা সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজের অসংখ্য নারীর অমূল্য গল্পগাথার একটা টুকরো মাত্র । এখানে শত শত নারী খুঁজে পেয়েছেন আত্মমর্যাদা, আত্মবিশ্বাস আর সেই সাথে নিজের ও তার প্রিয়জনদের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার সুযোগ। আপনি সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসের তৈরি প্রতিটি পণ্যের এই অসাধারণ গল্পের একটা অংশ হয়ে ওঠেন, আপনিও হয়ে ওঠেন সেই ট্যাপেস্ট্রির একটি সুতো যেখানে রোজিনার মতো নারীরা ভালোবাসা, পরিশ্রমআর অটুট মনোবলের সাথে বুনছেন দিন বদলের ইতিহাস, যারা প্রমাণ করেছেন একটি ছোট্ট সুই এর ফোঁড় বদলে দিতে পারে একটি জীবন এমনকি পুরোবিশ্বকেও।
কাজেই, এরপর আপনি যখন আমাদের কোন পণ্য স্পর্শ করবেন, মনে রাখবেন এক খন্ড কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে থাকা রোজিনা আর তার মতঅগুণিত নারীর জীবনের স্বপ্ন। মনে রাখবেন, আপনি শুধু যে একটি পণ্য কিনছেনতা নয়, আপনি লগ্নি করছেন একটি আন্দোলনে, যতই ছোট হোক না কেন,সুতোয় সুতোয় যা বুনে চলেছে আশা আর শক্তির গল্প, যার জন্ম বাংলাদেশের সৈয়দপুরের হৃদয়ের মণিকোঠায়।
শবনমঃ সুই এর ফোঁড়ে বদলে যাওয়া এক জীবনের নাম
সেলাই মেশিনে সচল হাত শবনমকে সাহায্য করে জীবনের একঘেয়ে থমকে থাকা জীবনকে ছন্দময় করে তুলতে। সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসের ১৫ বছরের যাত্রায় তিনি শুধু ব্যাগই বানান নি, বুনেছেন নিজের পরিবারের জন্য এক স্থিতিশীল ভবিষ্যত, গড়েছেন নিজের ঘর। ২০০৮ সালে শবনমের জীবন ছিলো ভিন্ন এক অধ্যায়। দুই মেয়েকে নিয়ে ঘড়ি মেরামতকারী স্বামীর সামান্য আয়ে কোনোমতে চলতো তার সংসার। স্বপ্নগুলো তখন যেন ছিলো বিবর্ণ ছেড়া কাপড়ের টুকরোর মতো। পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবদান রাখার জন্য সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসে যোগদান তার জন্য ছিলো একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর ফলাফল শুধু বেতনের অংকে সীমাবদ্ধ থাকেনি, যে সম্মান, জীবনের যে উদ্দেশ্য আর সহকর্মীদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ যে সম্পর্কের বন্ধন এখানে তিনি পেয়েছেন তা তার কাছে ছিলো অপ্রত্যাশিত এক প্রাপ্তি।
শবনমের তৈরি প্রতিটি ব্যাগের সাথে জড়িয়ে আছে নিজের একটি ঘর নির্মানে তার অবদানের গল্প। যে সংকীর্ণ ঘরে একদিন জায়গার অভাব ছিলো তা এখন পরিণত হয়েছে উষ্ণ একটি আশ্রয়ে। তার দুই মেয়ে এখন উজ্জ্বল আগামীর পথে। বড় মেয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আর ছোট মেয়েটি হাইস্কুলের শেষ বর্ষে।
‘’জীবনে এখনও কিছু চড়াই-উৎরাই আছে”, চোখে হাসির ঝিলিক নিয়ে শবনম বলেন, ‘’কিন্তু পরিবার হিসাবে আমরা একসাথে তা মোকাবিলা করি। আমার পরিবার আর সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসের সহকর্মীরা আমার পাশে আছেন বলেই প্রতিবছর আমি আরো শক্তিশালী হচ্ছি বলে মনে হয় আমার।“ সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজের মত একটি জায়গা শবনমের মতো মানুষদের জন্য নাটকীয় পরিবর্তনের গল্প নয়, এটি স্থিতিশীল একটি অগ্রগতির পথ। শেখায়, কিভাবে নিপুনভাবে করা একটি কাজের নীরব পরিতৃপ্তি আর শেখায় একেকটি দিনে, একটি করে সুন্দর কাজের মাধ্যমে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে তুলতে।
লাডলি: দৃঢ়তার এক প্রতীক
লাডলির প্রতিটি সেলাই সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসে ১৮ বছরের পথ চলায় তার অদম্য দৃঢ়তার এক প্রতিচ্ছবি। তার জন্য এটি শুধু সুচিশিল্প বা সেলাই এর কাজ ছিলো না, বরং যখন দুর্ভাগ্য তাকে গ্রাস করে ফেলেছিলো তখন এই কাজ তার পরিবারকে টিকিয়ে রাখার একটা অন্যতম অবলম্বন ছিলো। ২০০৬ সাল ছিলো তার জীবনের কঠিনতম একটি অধ্যায়। তার স্বামী, যিনি পেশায় ছিলেন একজন দর্জি হঠাৎ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন। তখন লাডলির কোল জুড়ে দুটি ছোট্ট সন্তান, সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যত। বুকের ভেতর সাহস আর হাতে সেলাই এর সুতো নিয়ে তিনি আশ্রয় খুঁজে নেন সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেসে। তারা শুধু তাকে চাকরীই দেয়নি, দিয়েছে আশা আর বিশৃক্ষলার মধ্যেএকটি নিরাপত্তাবেষ্টনী।
সময়ের লাডলির দক্ষতা যেমন বেড়েছে, সেই সাথে সুদৃঢ় হয়েছে তার একনিষ্ঠতা। এখন তিনি একজন দক্ষ সেলাই কারিগর আর সুচিশিল্পী। তাদের মেয়ে আকসা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তার মায়ের স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে। আর তাদের ছেলে জিশান এখন নবম শ্রেণির ছাত্র, সেও নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলেছে।
লাডলির যেই মুখে একসময় ছিলো চিন্তার রেখা, এখন সেখানে উদ্ভাসিত, প্রশান্তির হাসি। “আমার স্বামী এখন সেরে উঠছেন”, আবেগঘন কন্ঠে লাডলি বলেন, “সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজেস আমাকে সাহায্য করেছে নিজেদেরকেএকসাথে ধরে রাখতে, এখন আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎটাও সেলাই করছি, একেকটা সুতার ফোঁড়ে।“
কিন্তু লাডলির এই গল্প শুধু তার একলার নয়। সৈয়দপুরের অসংখ্য নারীর গল্প একই সুতোয় গাঁথা, যেখানে তারা প্রতিকুলতাকে জয় করে তাদের জীবন রুপান্তরিত হয় শক্তি আর আশার উদ্ভাসে।